একটি মহাআতংকের নাম ডায়েবেটিস।আচ্ছা এতো ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। একজন ডায়েটিশিয়ানকে বন্ধু বানিয়ে নিন, সাথে একটু নিয়ন্ত্রণ। কোনো ব্যাপারই না ডায়েবেটিসকে কাবু করতে। আসুন একটু শেষ পর্যন্ত জেনে নেই, কী করতে হবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০% (৮.৪ মিলিয়ন) মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, WHO-2014| World Health Organization – Diabetes Country Profile, 2016 – এর মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে প্রতি বছর মারা যায় ৬০৬০ পুরুষ এবং ৪৭৬০ মহিলা যাদের বয়স ৩০-৬৯ বছরের মধ্যে। ৭০ বা তার ওপরের বয়সে মারা যায় ৮২২০ পুরুষ এবং ৭৩৯০ মহিলা। ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিলতায় পুরুষ ৪.৬% এবং মহিলা ৭.৪% ভোগে।
ডায়াবেটিস মেলাইটাস কোনো এটি একটি বিপাকজনিতো সমস্যা। এ রোগে মানুষের শরীরের রক্তে গ্লুকোজ সাধারণ পরিমাণ- এর চেয়ে অনেকটাই বেড়ে যায়। তার কারণ হল শরীরে সঠিক পরিমাণ ইন্সুলিন তৈরী হয় না অথবা শরীরের ইন্সুলিন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে না।
তবে, জীবনশৈলী ও খাদ্য তালিকা পরিবর্তনের মাধ্যমে অনায়াসেই ডায়াবেটিস কমানো যায়।
ডায়েবেটিস প্রধানতো তিন প্রকার-
টাইপ ১ ডায়াবেটিস
সাধারণত ৩০ বৎসরের কম বয়সীদের টাইপ ১ ডায়েবেটিস হলেও যে কোনো বয়সের লোকই এ ধরনের ডায়েবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্বের মোট ডায়েবেটিক জনগোষ্টীর ৫-১০% এ ধরনের ডায়েবেটিসে ভোগে। টাইপ ১ ডায়েবেটিসের ক্ষেত্রে শরীরের অভ্যন্তরিন কিছু সমস্যাক কারণে অগ্নাশয়ের ইনসুলিন প্রস্তুতকারী বিটা কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায় ফলে ইনসুলিন একেবারেই তৈরী হয় না। আর তাই বেঁচে থাকার জন্য এদের ইনসুলিন দেয়া অত্যাবশ্যক।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস
আমাদের দেশের বেশিরভাগ ডায়েবেটিক ব্যক্তিই টাইপ ২ ডায়েবেটিসে আক্রান্ত হন।এদের শরীরে ইনসুলিনের আপেক্ষিক অভাবের পাশাপাশি ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারেনা, যাকে ইংরেজীতে বলে Insulin resistance। সাধারণত ৩০ বৎসরের অধিক বয়সী ব্যক্তিদের টাইপ ২ ডায়েবেটিস হয়ে থাকলেও কখনো কখনো অল্প বয়সেও হতে পারে। এদের রোগ প্রক্রিয়া কিছুটা মন্থর হওয়ায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ পায় না। টাইপ ২ ডায়েবেটিক ব্যক্তিদের ওজন সাধারণত স্বাভাবিক বা বেশী হয়ে থাকে।
গর্ভকালীন ডায়েবেটিস
গর্ভাবস্থার সময় মহিলাদের হঠাৎ করে ডায়াবেটিস বেড়ে যায় যাকে বলে গেষ্টেশনাল ডায়াবেটিস। এই সময় যদি সঠিকভাবে প্রতিকার ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে পরিণত হতে পারে।
ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী এশিয়াতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেশি থাকে।
মহিলাদের ক্ষেত্রে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পি.সি.ও.ডি থাকলে এই ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে।
এছড়াও অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়েবেটিস রয়েছে। যথা-হরমোন রোগ, স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ,অগ্নাশয়ের রোগ ইত্যাদির কারণে কখনো কখনো রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যায়।
ডায়েবেটিসের লক্ষণ কী তা জেনে নেই চলুন-
ডায়েবেটিসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত-
- বেশী বেশী প্রস্রাব হওয়া
- বেশী বেশী পিপাসা পাওয়া
- বেশী বেশী ক্ষুধা লাগা
- ওজন কমে যাওয়া
- দূর্বল হয়ে যাওয়া
এবার বলবো কী খাবার আপনার ডায়েবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে যাদুর মতো সাহায্য করবে-
- নাশপাতি
- নাশপাতিতে বিদ্যমান পলিফেনল টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে।পলিফেনল রক্তের শর্করার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। সপ্তাহে পাঁচবারের বেশি নাশপাতি খেলে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ে। এটি চোখ, ত্বক এবং কিডনির সমস্যাও দূর করতে সাহায্য করে। একটি পরিপূর্ণ নাশপাতি ফলে ৬ গ্রাম ফাইবার ১০০ গ্রাম ক্যালোরি ২৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। তাই নাশপাতি সুগার কন্ট্রোল করতে পারে কারণ নাশপাতির মধ্যে থাকা এই কার্বোহাইড্রেট আর ফাইবারের কম্বিনেশন শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
- আমলকি
- আমলকি একটি সুপার ফ্রুট নামে পরিচিত। আমলকির মধ্যে ক্রোমিয়াম নামক মিনারেল পাওয়া যায়। যা আমাদের শরীরের কার্বোহাইড্রেট মেটাবোলিজম কে বুস্ট করে আর ইনসুলিন তৈরী করেতে সাহায্য করে।তাই প্রতিদিন ২-৪ টি আমলকি গ্রহণ করুন।
- পেয়ারা
- পেয়ারা সুগার কন্ট্রোল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পেয়ারার মধ্যে ফাইভার, ল্যাকপিন, পটাসিয়াম, ভিটামিন সি,ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এর মত মিনারেলসে ভরপুর থাকে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে যদি প্রতিদিন একটি পেয়ারা গ্রহণ করেন তাহলে ব্লাড প্রেসার কে কন্ট্রোলে নিয়ে আসা সম্ভব। তবে যেই ফল ই খান না কেনো, দুপুর অথবা রাতের ভারী খাবারের পরপর খাবেন না। ৩০ মিনিট পর গ্রহণ করুন।
- ডিম
- প্রকৃতপক্ষে, ডিম আপনাকে ঘন্টা ধরে পরিপূর্ণ রাখার জন্য সেরা খাবারগুলির মধ্যে একটি। ডিম ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে এইচডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং আপনার “খারাপ” এলডিএল কোলেস্টেরলের আকার এবং আকার পরিবর্তন করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, হাই-যারা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতিদিন ১টি ডিম খাওয়ান এবং তাদের কোলেস্টেরল এবং রক্তে শর্করার মাত্রায় উন্নতি ঘটেছে।এছাড়াও ডিমে রয়েছে লুটেইন এবং জেক্সানথিনের অন্যতম অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা চোখে রোগ থেকে রক্ষা করে। সপ্তাহে ৪ দিন কুসুমছাড়া একটি ডিম ও বাকি ৩ দিন কুসুমসহ একটি ডিম খেতে পারেন।
- করলা
- গবেষণায় দেখা গেছে, করলাতে রয়েছে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক যৈ ইনসুলিন ইনজেকশনের থেকেও অনেক ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। চিকিৎসকরা বলছেন, কাঁচা করলা বা করলার রস নিয়মিত খেতে পারলে ডায়াবেটিসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। করলার মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী এনজাইম।এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে নিতে সাহায্য করে।
- মটরশুঁটি ও ব্রোকলি
- ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অনেক উপকারী। মটরশুঁটিতে আছে ভরপুর ফাইবার। মটরশুঁটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রাকে সাধারণ মাত্রায় রাখে। ব্রোকলি একটি ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ এমন একটি বিশেষ যৌগ আছে যা ডায়াবেটিস এর সাথে যুদ্ধ করে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
- বাদাম
- বাদামে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম, আঁশ ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় উপাদান থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাদাম ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বেশ কার্যকর। চিনাবাদাম ডায়াবেটিসের ঝুঁকি প্রায় ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কিছু কাঠবাদাম,চিনাবাদাম ইত্যাদি রাখলে তা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভালো কাজ দেয়।
- আপেল
- আঁশযুক্ত আপেল খেলে সুগার কন্ট্রোলে থাকে। আপেল ফাইভার, ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। আপেলে থাকা ফাইবার ও কার্বোহাইড্রেট হজম করতে সাহায্য করে। যার ফলে সুগার লেবেল কন্ট্রোল থাকে।তবে তবে কথা আছে,মিষ্টি লাল আপেল নয়, বাজারে পাওয়া যায় যেসকল একটু টক সবুজ আপেল।
- টক দই
- টক দইতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি থাকে। তাছাড়া মজবুত হাড় ও সুস্থ দাঁতের জন্যও টক দই উপকারী।ডায়েবেটিক রোগীর দাঁত ও হাঁড় ঠিক রাখতে দুধ হজম না হলে টক দই খেতে পারেন। এতে চিনির পরিমাণ খুবই কম। ফলে টক দই রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। দুপুরে খাবারের পর কিংবা বিকালে নাস্তার সঙ্গে টক দই গ্রহণ করতে পারেন।
তাছাড়াও মেথি, জাম, কালোজিরা, টক জাতীয় ফল যেমন- টক আঙ্গুর, কমলালেবু ইত্যাদি ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
যেসকল খাবার পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমান বুঝে খেতে হবে-
আটার রুটি,তন্দুর রুটি,ভাত,মুড়ি,চিড়া,খৈ,নুডুলস,সেমাই,আলু,মিষ্টি আলু,নোনতা বিস্কিট,মাংস,পনির,মাখন,ডালডা,নারিকেল,ঘি,আলু,কচু,মোচা,গাজর,কাঁকরোল,কাঁঠাল,আম,কচুরমুখী,বেগুন,ঢেড়শ,শালগমপাকা পেঁপে,পাকা কলা,মিষ্টি বড়ই,তরমুজ,খেজুর ইত্যাদি।
অনেক হলো খাবারদাবার। এবার যে আপনাদের কিছু সতর্ক করতেই হয়। পরে দিবো টিপস। আগে পায়ের যত্ন নিয়ে বলে নেই। ডায়েবেটিক পেশেন্ট সবচেয়ে অবহেলা করে পা নিয়ে। এমনো রোগী পাওয়া যায় যাদের ২ পা কেটে ফেলে দিতে হয়।কেনো জেনেশুনে ভুল করবেন না তাই পায়ের যত্ন কীভাবে নিবেন তা বলে দিবো।
ডায়েবেটিস জনিত পায়ের সমস্যা তিন ধরনের
- স্নায়ু বৈকল্য জনিত (নিউরোপ্যাথি)
- রক্ত চলাচল কমে যাওয়া
- ইনফেকশনজনিত
বুঝতেই পারছেন পায়ের যত্ন নিতেই হবে। তাই চলুন জেনে নেই কীভাবে নিবেন পায়ের যত্ন
#পা অস্বাভাবিক গরম থাকে কিনা দেখতে হবে।
#পা কখনো শুকনো খসখসে রাখা যাবেনা,প্রয়োজনে লোশন বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করতে হবে।
#পুঁজ বা পানি বের হয় কিনা দেখতে হবে।
#লাল,ফুলে যাওয়া,ব্যথা হওয়া এদের কাউকেই অবহেলা করা যাবেনা।
#গরম ঠান্ডার অনুভূতি আছে কীনা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
#পায়ে অত্যধিক গরম পানি ঢালবেন না।
#পায়ে যেন কোনো আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
#নিয়মিত পায়ের বাড়তি নখ কাটবেন, নখ কাটার সময় বিশেষভাবে সাবধানতা অবলম্বন করবেন, যাতে আঙ্গুলে আঘাত না লাগে।
#পায়ের কড়া নিজে কাটবেন না। ময়লা বা ভিজে মোজা পরবেন না।
#রক্ত চলাচলের জন্য রোজ নিয়মিত পায়ের ব্যায়াম করবেন।
#জুতা অবশ্যই নরম ও মাপমতো হতে হবে।
#খালি পায়ো হাটবেন না।
#পায়ের আঙ্গুলের মাঝখানে ভেজা রাখা যাবেনা।
#ভালোভাবে দেখার জন্য আয়না ব্যবহার করতে পারেন বা অন্যের সাহায্য নিতে পারেন।
এবার কিছু সাধারণ টিপস-
#একজন ডায়েটিশিয়ান দেখিয়ে নিজের খাবারের চার্ট করে নিন।
#ডায়াবেটিক রোগীরা খাবার স্যালাইন খেতে পারবে। তবে তা শুধু ডায়রিয়া হলে বা বারবার বমি হলে।
#প্রতিদিন অন্তত চার বার রক্তের গ্লুকোজ মেপে নিবেন।
#হাইপোগ্লাইসেমিয়া মানে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল ২-৩ এর মধ্যে হলে দেরী না করে চা চামচের ৩-৪ চামচ চিনি/মধু দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিবেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিতো ধারণা চিকিৎসকের কাছ থেকে অবশ্যই জেনে নিবেন।
#৩৫-৪০ মিনিট ঘাম ঝড়িয়ে হাঁটবেন,বাসার রুমে অথবা ছাদে।
#কোনো কাঁটা ছেড়াকে অবহেলা না করে দ্রুতো চিকিৎসকের নিকট শরণাপন্ন হবেন।
#ইনসুলিন নেয়ার পদ্ধতি ও নিয়ম জেনে নিবেন নিজ দায়িত্বে।
#এক বেলা কম এক বেলা বেশি খাবার খাবেন না।
#পরিবারের যেকোনো ১/২ জনকে আপনার দায়িত্ব নেয়ার ব্যবস্থা করবেন যে কোনো সমস্যা মোকাবেলা করতে।
#ঔষধের ডোজ নিয়ে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিবেন।
এখন করোনাকালীন সময়,বাইরে বের হবেন না।একান্ত কেউ বাসায় না থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বের হবেন।ভয়কে জয় করুন।ডায়েবেটিস কোনো আতংক নয়,নিয়ম মেনে চললে বনের বাঘ ও পোষ মানে।আর এ তো সামান্য ডায়েবেটিস!